স্বদেশপ্রেম রচনা

রচনাঃ স্বদেশপ্রেম।

স্বদেশপ্রেম রচনা
স্বদেশপ্রেম রচনা

    ভূমিকা

    ইসলাম ধর্মে আছে,'দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ'। স্বদেশ মানষের কাছে পরম সাধনার ধন এবং নিশ্চিন্ত নিবাস। স্বদেশের মানুষ, স্বদেশের রূপ-প্রকৃতি, তার পশুপাখি এমনকি তার প্রতিটি ধূলিকণাও তার নিকট প্রিয়, পবিত্র। যে দেশ আলাে দিল, বাতাস দিল, অন্ন-পানি দিল, বস্ত্র দিল, তার প্রতি যদি সেই শ্যামল স্নেহে প্রতিপালিত সন্তানদের মমতামণ্ডিত আনুগত্যবােধ না থাকে, তবে তারা অকৃতজ্ঞ।

    স্বদেশপ্রেম

    যে ভৌগােলিক ও সামাজিক পরিবেশের মধ্যে মানুষ জন্মগ্রহণ করে এবং বেড়ে ওঠে, সে পরিবেশের প্রতি, সেখানকার মানুষের প্রতি একটি স্বাভাবিক আকর্ষণ গড়ে উঠে। দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি এ আজন্ম আকর্ষণই বলা হয় স্বদেশপ্রেম। স্বদেশপ্রেম সকলের অন্তরেই থাকে। কখনও এ প্রেম থাকে সুপ্ত অবস্থায়, কখনাে আবার তা প্রকাশ পায়। সুখের দিনে স্বদেশপ্রেম থাকে সপি কিন্তু দুঃখের দিনে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে স্বদেশপ্রেম উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। পরাধীনতার দুঃখ-বেদনায়, পরদেশির নির্যাতনে অন্তরের স্বদেশপ্রেমের ঘুম ভাঙে। কিংবা দেশ যখন শত্রুর আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়, তখন সমগ্র জাতি স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বদেশের ও স্বজাতির মানমর্যান রক্ষাকল্পে রণক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার জন্য দলে দলে ছুটে যায়। তখন মনে হয়- 

    "নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই, তার ক্ষয় নাই। "

                                                                    -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

    স্বদেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ ও উন্মেষ

    প্রকৃতপক্ষে স্বদেশপ্রেমের উদ্ভব আত্মসম্মানবােধ থেকে। যে জাতির আত্মসম্মানবােধ যত প্রখর, সে জাতির স্বদেশপ্রেম তত প্রবল। স্বদেশপ্রেম এক প্রকার পরিশুদ্ধ ভাবাবেগ। নিঃস্বার্থ হিংসাহীন দেশপ্রেমই প্রকৃত স্বদেশপ্রেম। ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থের গতির উপেক্ষা করে বৃহত্তর স্বার্থের দিকে মন যখন পরিচালিত হয়; যখন আত্মকল্যাণ অপেক্ষা বৃহত্তর কল্যাণবােধ সক্রিয় হয়ে ওঠে, তখন জলে art স্বদেশের প্রতি ভালােবাসার নিষ্কলুষ প্রদীপ শিখা। স্বদেশপ্রেমিকের দেশ সেবার পথে বাধা অনেক, অত্যাচার সীমাহীন। কিন্তু পথের ঝড়, ঝঞা, প্রতিবন্ধকতা তাদের দৃঢ় বলিষ্ঠ পদক্ষেপের নিকট মিথো প্রমাণিত হয়। ইতিহাসের পানে তাকালে এর ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত মেলে। পরদেশি কিংবা স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু কিংবা উদ্যত অস্ত্র দেশপ্রেমীকদের নিরল করতে পারে না। আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাসও স্বদেশপ্রেমের গর্বে গর্বিত। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১। সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং সর্বশেষে ১৯৯০ সালে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান আমাদের অনন্য স্বদেশপ্রেমের প্রমাণ দেয়।

    দেশপ্রেম ও রাজনীতি

    বস্তুত রাজনীতিবিদদের প্রথম ও প্রধান অবলম্বনই হলাে দেশপ্রেম। স্বদেশপ্রেমের পবিত্র বেদিমূলেই রাজনীতির পাঠ। | দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ রাজনীতিবিদ দেশের সদাজাগ্রত প্রহরী। পরাধীন বাংলাদেশের দিকে দিকে যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গড়ে উঠেছিল, তাদের সকলেরই মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল পরাধীনতার বন্ধন থেকে দেশজননীর শৃঙ্খল-মােচন। তাদের অবদানেই আজ দেশ স্বাধীন। আজও দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বর্তমান। রাজনীতির রঙ্গমঞে এখনাে কত নতুন দলের আবির্ভাব ও নিষ্ক্রমণ । কিন্তু অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই মহত্তর, বৃহত্তর কল্যাণবােধ থেকে ভ্রষ্ট। ব্যক্তিক এবং দলীয় স্বার্থ চিন্তাই অনেক ক্ষেত্রে প্রবল। দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে মানুষের প্রয়ােজনে সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়ার সাধনা, দেশপ্রেমের অঙ্গীকার এখন প্রায়ই অনুপস্থিত।

     স্বদেশপ্রেম ও বিশ্ব ভাবনা

    যথার্থ দেশপ্রেমের সঙ্গে বিশ্বপ্রেমের কোনাে অমিল নেই, নেই কোনাে বিরােধ, বরং স্বদেশপ্রেমের ভেতর দিয়ে বিশ্বপ্রেমের এক মহৎ উপলব্দিরও জাগরণ ঘটে। স্বদেশ তাে বিশ্বেরই অন্তর্ভুক্ত। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের উর্ধ্বে মানুষ বিশ্বপ্রেমের এ বাণীকে জাতীয় জীবনে গ্রহণ করলেই সংকীর্ণ অন্ধ জাতীয়তাবােধ থেকে আমাদের মুক্তি সম্ভব। বিশ্বপ্রেমের উজ্জ্বল আলােকে আমাদের স্বদেশপ্রেম হবে। উদ্ভাসিত। আমরা স্বদেশকে ভালােবেসে বিশ্বদেবতারই বন্দনা করি। তাই রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়

                                  “ও আমার দেশের মাটি, তােমার পরে ঠেকাই মাথা, 

                                 তােমাতে বিশ্বময়ীর— তােমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।” 

    আজ যখন বিশ্বের সর্বত্র গণতন্ত্রের প্রবল জোয়ার এসেছে তখন বিশ্ব নাগরিকত্বের চেতনা হবে তাকে যথার্থভাবে গ্রহণ করার। স্বদেশচেতনা তাে বিশ্ববােধেরই প্রাথমিক শর্ত। দেশের জল-মাটি-অরণ্য-পশুপাখি-মানুষ-সংস্কৃতিকে ভালােবাসতে পারলে পৃথিবীর মানুষ ও প্রকৃতিকেও ভালােবাসা যায়। 

    অন্ধ স্বদেশপ্রেমের পরিণতি

    স্বদেশপ্রেম দেশ ও জাতির গৌরবের বস্তু। কিন্তু অন্ধ স্বদেশপ্রেম ধারণ করে ভয়ংকর রূপ। জাতিতে জাতিতে সংঘাত ও সংঘর্ষ অনিবার্য করে তােলে অন্ধ স্বদেশপ্রেম । আমরা স্বদেশের জয়গান গাইতে গিয়ে যদি অপরের স্বদেশপ্রেমকে আহত করি, তবে সেই স্বদেশপ্রেম বিভিন্ন দেশ ও জাতির মধ্যে ডেকে আনে ভয়াবহ রক্তাক্ত দ্বন্দ্ব-সংঘাত। হিটলারের ইউরােপ দখল কিংবা মুসােলিনির ইতালি উগ্রজাতীয়তাবাদের নগ্নরূপ। চলমান বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্র কর্তৃক দুর্বল রাষ্ট্রসমূহের প্রতি আগ্রাসী মনােভাব অন্ধ স্বদেশপ্রেমেরই বহিঃপ্রকাশ। অন্ধ স্বদেশ প্রেমাসক্ত নীতি বিশ্বকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে, পারে মানবতার বিপর্যয় ঘটাতে। 

    উপসংহার

    দেশপ্রেম আমাদের মনের জ্বলন্ত অগ্নিশিখা। সেই অনলে অন্তরের যত কিছু পাপবােধ, যা কিছু ক্ষুদ্র, গ্লানিময়তার আহূতি দানেই আমাদের জীবন পরিশুদ্ধ হয়। এক মহৎ চেতনার বিভায় মানবজন্ম হয় ভাস্বর। মানুষের জীবনে যদি দেশপ্রেমের চেতনা না থাকে, যদি বৃহত্তর কল্যাণবােধ থাকে অসুন্দরের ছদ্মবেশে আচ্ছন্ন, তাহলে হৃদয়ের কোন ঐশ্বর্য নিয়ে মানুষ মহৎ হবে? বৃহৎ হবে কোন সম্পদ নিয়ে? কোথায় তাহলে জীবনের মহিমা? কোথায় সেই উন্নত উত্তরাধিকার? দেশপ্রেম তাে শুধু কতগুলাে প্রাণহীন শব্দসমাহার নয়, নয় কোনাে নিছক বিমূর্ত আদর্শ। সুতরাং এ প্রসঙ্গে। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতার চরণ দুটি প্রণিধানযােগ্য । | ‘স্বদেশের উপকারে নেই যার মন | কে বলে মানুষ তারে পশু সেই জন। স্বদেশপ্রীতির মধ্যেই রয়েছে মনুষ্যত্বের উদ্বোধন, মহঞ্জীবনের সংকল্প, বিশ্বভ্রাতৃত্বের বন্ধন।

    এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

    পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
    এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
    মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন
    comment url